গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ইউরোপের প্রায় সব দেশই তেল আবিবকে সমর্থন দিচ্ছে। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার নিন্দা জানাচ্ছে না দেশগুলো। কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে পরিচিত ও শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানালেন পেদ্রো সানচেজ। তিনি ছাড়া শুধু আয়ারল্যান্ড ও বেলজিয়ামের রাজনীতিকেরা গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন।
গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরুর পর থেকেই বিক্ষোভ হচ্ছে দেশটিতে। গাজায় হামলার প্রতিবাদে স্পেনজুড়ে শহরে শহরে বিক্ষোভ করে আসছেন দেশটির নাগরিকেরা।
স্পেনের সংখ্যালঘু বামপন্থী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পেদ্রো সানচেজ। এ জোট সরকারে অতি বামপন্থী হিসেবে পরিচিত সুমার ও পোদেমোসের মতো দলও শরিক। বামপন্থী এসব দল ও দলের নেতারা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা ও তাঁদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছেন।
স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে স্পেনকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে রেখেছিল পশ্চিমারা। সেই সময় আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্পেনের মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর ১১ বছর পর ১৯৮৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করে স্পেন।
স্পেনের ক্যান্টাবারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইন বিভাগের অধ্যাপক হোসু ডি মিগুয়েল স্পেনকে ‘সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনপন্থী একটি দেশ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন সানচেজ। জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই অবস্থান না নিলেও স্পেন সে অবস্থান নিয়েছে।’
স্পেন সরকারের এমন অবস্থানের ব্যাখ্যায় অধ্যাপক মিগুয়েল আরও বলেন, ‘স্পেনের (জোট) সরকারে এমন অনেক দল রয়েছে, যেসব দল ইসরায়েল নয়, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল।’
আরব–স্পেন অতীত সম্পর্ক
স্পেন যে হঠাৎ করে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছে, বিষয়টি অবশ্য এমনও নয়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি স্পেনের সম্পর্কের শিকড় রয়েছে এর ইতিহাসে।
স্পেনে ইহুদির সংখ্যা অনেক কম, সর্বোচ্চ ৫০ হাজার হতে পারে। এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণও আছে। ১৪৯২ সালে আলহামব্রা ডিক্রি জারি করে ইহুদিদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে স্পেনকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে রেখেছিল পশ্চিমারা। সেই সময় আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্পেনের মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর ১১ বছর পর ১৯৮৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করে স্পেন।
অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রিদের স্পেনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইগনাসিও মলিনা বলেন, ‘ফ্রাঙ্কো ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন কি না, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু তাঁর শাসনামলে স্পেন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। অপর দিকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছিল।’
ইগনাসিও মলিনা আরও বলেন, ‘১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন থেকে স্পেনে গণতান্ত্রিক শাসনে উত্তরণের সময়েও দেশটির মধ্যপন্থী সরকারগুলো ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদ পাওয়ার শর্তে ১৯৮৬ সালে এসে এই স্বীকৃতি দেয় স্পেন।’
২০১৪ সালে স্পেনের পার্লামেন্টে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির পক্ষে একটি প্রতীকী প্রস্তাব পাস হয়। ইগনাসিও মলিনা বলেন, ‘বাম ও ডানপন্থী স্পেনের উভয় পক্ষেরই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর একটা রীতি আছে। যদিও ডানপন্থীরা ইসরায়েলের দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকে।’
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন প্রশ্নে সানচেজ সরকারের এমন অবস্থানের অবশ্য সমালোচনা করছে ডানপন্থী ও রক্ষণশীল দলগুলো। সম্প্রতি স্পেনের কট্টর ডানপন্থী দল ভক্স পার্টি অভিযোগ তোলে, বহির্বিশ্বে স্পেনকে লজ্জায় ফেলেছেন সানচেজ। রক্ষণশীল পিপলস পার্টিও এমন অভিযোগ তুলছে।
গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধে সরকারের আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন স্পেনের ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ। পক্ষান্তরে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশের মতে মাদ্রিদের এ থেকে দূরে থাকা উচিত এবং প্রায় ১৭ শতাংশের নির্দিষ্ট অবস্থান নেই।
এর আগে অক্টোবরে করা এক জরিপে অবশ্য বিভাজনটা ছিল আরও বেশি। ওই জরিপে দেখা যায়, স্পেনে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ফিলিস্তিনকে সমর্থন করেন। এ ছাড়া ৪৩ শতাংশ মানুষের ইসরায়েল সম্পর্কে এবং ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশের ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে কোনো অবস্থান নেই।
অনুবাদ: আল–আমিন সজীব